জগন্নাথ রথযাত্রা একটি জনপ্রিয় হিন্দু উৎসব, যা দেবতা জগন্নাথ (বিষ্ণু বা কৃষ্ণের একটি রূপ) এর উদ্দেশ্যে পালিত হয়। এই উৎসবটি মূলত ওড়িশার পুরী শহরে অনুষ্ঠিত হলেও বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানেও এই রথযাত্রা পালিত হয়। রথযাত্রা মূলত ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তাদের মন্দির থেকে মাসির বাড়ি (গুণ্ডিচা মন্দির) পর্যন্ত রথে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। এই উৎসবটি ভক্তদের মধ্যে আনন্দ ও ভক্তির এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করে। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া একটি আষাঢ় মাসে আয়োজিত অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এই উৎসব বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এছাড়া ইসকনের ব্যাপক প্রচারের জন্য এখন এটি বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। ভারতের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুর শহরের মাহেশের রথযাত্রা, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, কলকাতার রথ এবং বাংলাদেশের ইসকনের রথ ও ধামরাই জগন্নাথ রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ।
রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রার সময় যাত্রাপালা মঞ্চস্থের রীতি বেশ জনপ্রিয়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তাঁর স্ত্রী মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-সহ প্রমুখ ব্যক্তিরা রথের বিখ্যাত মেলা পরিদর্শনে আসতেন। শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন যাত্রাপালায় লোকশিক্ষা হয়
এখানে জগন্নাথ রথযাত্রার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
উৎপত্তি ও ইতিহাস:
রথযাত্রার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। লোকমুখে শোনা যায়, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ নির্মাণের জন্য একজন উপযুক্ত শিল্পী খুঁজছিলেন, এমন সময় এক বৃদ্ধ শিল্পী এসে মূর্তি তৈরি করতে রাজি হন। তিনিই ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। এই মূর্তিগুলিই পরবর্তীতে রথে করে মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, যা রথযাত্রার রূপ নেয়।
পুরীর রথযাত্রা:
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই উৎসবে যোগ দেন। এই উৎসবে তিনটি রথ ব্যবহৃত হয় – একটিতে জগন্নাথ, একটিতে বলভদ্র এবং অন্যটিতে সুভদ্রা অধিষ্ঠিত হন।
গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
রথযাত্রা ভগবান জগন্নাথের ভক্তদের সাথে মিলন ও ভালোবাসার প্রতীক। এই দিনে ভক্তরা রথ টেনে নিয়ে যান, যা তাদের ভক্তি ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। রথযাত্রা ভগবান জগন্নাথের পুরী থেকে মাসির বাড়ি (গুণ্ডিচা মন্দির) এবং সেখান থেকে পুনরায় মন্দিরে ফিরে আসার এক বিশেষ যাত্রা।
বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা:
পুরী ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাতেও বিভিন্ন স্থানে এই উৎসব পালিত হয়, যেমন – গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা যা প্রায় ২৮৫ বছরের প্রাচীন।
রথের বৈশিষ্ট্য:
পুরীর রথগুলি প্রায় ৪৫ ফুট উঁচু হয় এবং এগুলিতে ১৬টি করে চাকা থাকে। রথগুলি দড়ি দিয়ে টানা হয় এবং প্রতিটি রথের নিজস্ব নাম রয়েছে, যেমন – জগন্নাথের রথ “নন্দীঘোষ”, বলভদ্রের রথ “তালধ্বজ” এবং সুভদ্রার রথ “পদমধব”।
রথযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ভক্তিমূলক আনন্দ ও মিলন Mela রও উৎসব।
ইতিহাস
প্রতিমা তৈরির ইতিহাস
ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুযায়ী, কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুর সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ ও এই অসম্পূর্ণ রুপেই পূজা শুরু করতে বলেন।
রথযাত্রা প্রচলন
কথিত আছে, আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়ায় বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ। মাসির বাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি। সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ। এটাকেই জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে৷ পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে যান জগন্নাথ। এই যাওয়াকে সোজা রথ আর ফিরে আসাকে উল্টো রথ বলে।
উল্লেখযোগ্য রথযাত্রা
রথযাত্রা (পুরী) ওড়িশা রাজ্যের পুরীতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক পরিদর্শন করা রথযাত্রা প্রতি বছর প্রচুর ভিড় আকর্ষণ করে।
বারিপদ রথযাত্রা বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথযাত্রা। তাই বারিপদকে দ্বিতীয়া শ্রীক্ষেত্র বা দ্বিতীয় পুরীও বলা হয়। ১৫৭৫ সাল থেকে এখানে কোনো বাধা ছাড়াই রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে।
কেন্দুঝারের রথযাত্রা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা। কেওনঝার রথ (রথ) – নন্দীঘোষ বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা রথ।
বাম: চেন্নাইতে একটি গাড়ি উৎসবের (রথযাত্রা) একটি ১৯১৪ পেইন্টিং; ডানদিকে: নেপালে একটি মতসেন্দ্রনাথ রথযাত্রা
রথযাত্রা (পুরী) ওড়িশা রাজ্যের পুরীতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক পরিদর্শন করা রথযাত্রা প্রতি বছর প্রচুর ভিড় আকর্ষণ করে।
বারিপদ রথযাত্রা বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথযাত্রা। তাই বারিপদকে দ্বিতীয়া শ্রীক্ষেত্র বা দ্বিতীয় পুরীও বলা হয়। ১৫৭৫ সাল থেকে এখানে কোনো বাধা ছাড়াই রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে।
রথযাত্রা (আহমেদাবাদ) – গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদেও রথযাত্রা হয়, যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম হিসাবে পরিচিত।উড়িষ্যার সুকিন্দা রথযাত্রাও প্রচুর সংখ্যক ভক্তদের আকর্ষণ করতে পরিচিত।
ধামরাই রথযাত্রা, বাংলাদেশের ধামরাইয়ে অনুষ্ঠিত রথযাত্রা বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত রথযাত্রা।
ঢাকা ইসকনের রথযাত্রা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিখ্যাত রথযাত্রা।
রাজবলহাট রথযাত্রা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।